ডায়াবেটিস নিয়ে জীবন

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম | আপডেট: ০৩ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম

 

মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে যে রোগগুলো প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে একেই বলা হয়েছে মধুমেহ। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতায় এই রোগ সম্বন্ধে বর্ণনা আছে। বর্তমানে যে অবস্থাটি ডায়াবেটিস হিসাবে পরিচিত (সাধারণত ডায়াবেটিস মেলিটাসকে বোঝায়) তা ইবারস পাপাইরাসে খৃষ্টপূর্ব ১৫৫০ এ বর্ণনা করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। আয়ুর্বেদিক চিকিতৎসকরা (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম/৬ষ্ঠ শতক) প্রথম ডায়াবেটিক প্রস্রাবের মিষ্টি স্বাদ লক্ষ্য করেন এবং এই অবস্থাটিকে মধুমেহা (“মধু প্রস্রাব”) বলে অভিহিত করেন। বলা হয়েছে, এ রোগ নিরাময় হয় না, কিন্তু আয়ত্তে রাখা যায়। প্রস্রাবে চিনি, দুর্বলতা, ঘা না-শুকানো , বিষক্ত ফোড়া, গ্যাংগ্রীন, তন্দ্রাভাব এগুলো মধুমেহের লক্ষণ।

এই রোগ সারা জীবনের সঙ্গী হলেও নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, ওষুধ খাওয়া এবং সংযত জীবন যাপন করলে এ রোগের প্রকোপকে প্রতিরোধ করা যায়। ডায়াবেটিস নামকরণ হয়েছে সাইফস থেকে। এ রোগে খিদে বাড়ে, যৌনবাসনা কমে যায় এবং প্রসাবের স্বাদ মিষ্টি হয়।

কেন ডায়াবেটিস হয় তা বলা শক্ত। তবে এ রোগটি সংক্রামক নয়। পেটে পাকস্থলী নীচে অগ্নাশয় বা প্যাংক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন নামক পরিপাক সহায়ক হরমোন রক্তে বিপাক প্রক্রিয়ায় রক্তের শর্করাকে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায় ও গ্লাইকোজেন উৎপন্ন করে। কোনো কারণে অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন তৈরিতে ঘাটতি হলে বা ওই ইনসুলিন রক্তে না-মিশলে বা দেহে এর চাহিদা বেড়ে গেলে তখন খাবারের পর রক্তে আসা চিনির যথাযথ ব্যবহার হয় না এবং রক্তে চিনি বৃদ্ধি হয়।

কাদের সহজে ডায়াবেটিস হয় জানলে মানুষের পক্ষে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। যাঁদের বংশগত ইতিহাসে ডায়াবেটিস আছে তাঁদের শতকর ৪৬ জনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রোগা লোকের চেয়ে মোটা লোকেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। কায়িক পরিশ্রমীদের চেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, জজ, অফিসকর্মী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক প্রভৃতি বৃক্তিমূলক বুদ্দিজীবীরা বেশি আক্রান্ত হন। যে সব মহিলারা ইস্ট্রোজেন ঘটিত ঔষদ খান তাদের বেশী হয়। বাচ্চাদের চেয়ে বয়স্কদের এই রোগ হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে। বেশিদিন ধরে মূত্র অধিক হওয়ার ওষুধ ব্যবহার করলে এ রোগ হতে পারে। মামস, ফ্লু প্রভৃতি ভাইরাস শিশুদের অগ্ন্যাশয় আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্ত করলে এ রোগ হতে পারে।

বেশি মাত্রায় শ্বেতসার খেলে বা ফাস্ট ফুড বা উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার প্রচুর পরিমাণে ও বার বার খেলেও এ রোগ হতে পারে। মানসিক দুশ্চিন্তাও এই রোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক।

এই রোগের কতগুলো উপসর্গ দেখা দিলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। অজ্ঞাত কারণে দেহের ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ, দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া এ সব কারণে এ রোগ হতে পারে।
যদি খিদে বেড়ে যায়, মুখ শুকিয়ে যায়, তেষ্টা বেশি পায়, বারে বারে পানি খাওয়ার ইচ্ছা জাগে, এক সঙ্গে প্রচুর ও বারে বারে প্রস্রাব হয়, ওজন কমে যায়, শরীর দুর্বল বলে মনে হয়। দৃষ্টিতে অস্বচ্ছতা ও অকালে ছানি পড়া, গায়ে বা হাত-পায়ে ব্যথা ও যন্ত্রণা, রাত্রে পায়ে যন্ত্রণা ও খিচুঁনি হয়, প্রায়ই ঠান্ডা লাগে, সর্দি-কাশি, ফোড়া, কার্বঙ্কল, ঘা শুকাতে দেরি হচ্ছে বা মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয় তাহলে ডায়াবেটিস রোগের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্প্রতি সমীক্ষায় জানা গেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মৃত্যুতে হার বাড়ার অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। আজকাল যত্রতত্র শিল্প স্থাপনের ফলে পরিবেশ দূূষণে লোকদের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি।
ডায়াবেটিস নানা রকমের হতে পারে। আমাদের দেশে মেয়েদের তুলনায় পুরুষরা চল্লিশ পার হলেই আক্রান্ত হন বেশি এ রোগে। এদের সাধারণত প্রথমেই ইনসুলিন দিতে হয় না। ডায়াবেটিস নিরোধন বড়ি খেলেই কাজ করে। কুড়ি বছরের নীচে বয়ঃসন্ধিকালের ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ইনসুলিন নিতে হয় সাধারণত প্যাংক্রিয়াস সক্ষম না হওয়ার জন্য বাচ্চাদের এ রোগ হলেও ইনসুলিন ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব হয় না। গ্রামে মানুষদের কম খরচে যাতে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা যায় তার জন্য সরকারী হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।

অ্যাকিউট ক্রাইসিস অবস্থায় ডায়াবেটিস প্রধান উপসর্গ হল ডায়াবেটিস কোমা বা অচৈতন্য হওয়া। অবিলম্বে চিকিৎসা না করলে মৃত্যু অনিবার্য। ক্রনিক অবস্থায় হাইব্লাড প্রেসার, হার্টের রোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, করোনারি থ্রম্বোসিস, নি¤œাঙ্গের রক্তবাহী নালী শুকিয়ে যাওয়া, চোখের রেটিনার রোগের জন্য অন্ধত্ব, দাঁত ও মাড়ির রোগ, পেট ও কিডনির গন্ডগোল, পাথুরী, মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসব ইত্যাদি হতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীকে পা সম্পর্কে বিশেষ সচেতন থাকতে হবে । খালি পায়ে হাঁটবেন না। জুতা ও চপ্পল ঠিক মাপে পরতে হবে। টাইট জুতোয় রক্ত চরাচলের অসুবিধা ও ঢিলে জুতোয় পায়ে কড়া হয়। লাইলনের মোজা না পরা, পায়ে ঘা হতে না দেওয়া, পায়ে চুলকানি হলে, ফুলে গেলে বা রংয়ের পরিবর্তন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। পা সর্বদা পরিস্কার রাখা ও পায়ের নখ সন্তর্পণে কাটতে হবে, পদ্মাসনে বেশিক্ষণ বসা ঠিক নয়, পায়ের কড়া চিকিৎসক দিয়ে কাটা উচিত। কড়ায় কোনও প্লাস্টার বা লোসন ব্যবহার না করাই বিধেয়। চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হয়। কখন কতটা কি খেতে হবে জানার চেয়ে দৈনিক কতটা ক্যালরি খাদ্য নিতে হবে সেটা জানা বেশি প্রয়োজন।

আমাদের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ত্রিশ ক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন। স্থূলকায়রা প্রতি কেজির জন্য ২০-২৫ ক্যালরি, বৃদ্ধরা ১০০০ থেকে ১৫০০ ক্যালরি, মধ্যবয়সীরা ১৫০০-২০০০ ক্যালরি, অল্প বয়স্কদের ২০০০-৩০০০ ক্যালরি খাদ্য খাওয়া উচিত। কি কি খাওয়া যেতে পারে? পরিমিত মাত্রায় গম বা চাল জাতীয় শস্য, যথেষ্ট পরিমাণে শাকসবজি। উচ্ছে, করলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, ঢ্যাঁড়স, থোড়, ঝিঙে, এঁচোড়, ছাঁটি কুমড়ো, টম্যাটো, পটল, লাউ, চিচিঙ্গে, ডুমুর, মোচা, বীন, বরবটি, ধুন্দুল, সীম, কড়াই শুটি, সজনা, ডাটা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খাওয়া যায়।

মাছ (ছোট), মাংস, টকদই পরিমিত পরিমাণে, চিনি ছাড়া কফি, টোস্ট জাতীয় বিস্কুট, ক্রিমক্রেকার ও নোনতা বিস্কুট, কর্ণফ্লেক্স, মুড়ি, খোলায় ভাজা চিঁড়ে, বাদাম ও ছোলা-মটর ভাজা, মিষ্টি বিহীন চানাচুর ও ডালমুট খাওয়া যেতে পারে।
প্রাণীর লিভার, হার্ট, কিডনি, ব্রেন, চিংড়ি, কাঁকড়া, ডিমের কুসুম, চকলেট, কেক, পেস্ট্রী, আইসক্রীম, চিনি, টাটকা মধু, জ্যাম, জেলি, মিষ্টান্ন, কোল্ড ড্রিংক, মাখন, ঘি, মাছের তেল, চর্বি, খোয়া ক্ষীর, আলু, বীট, শাকা আম, সবেদা, বেল, পেঁপে ইত্যাদি খাবার একদম চলবে না। বিড়ি-সিগারেট ইত্যাদি ধুমপান, মদ বা ওই জাতীয় পানীয় সর্বদা বর্জনীয়।
পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা, চিকিৎসা, নিয়মিত ভ্রমণ ও ব্যায়ামাদিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে এসব নিয়ম মেনে চললে দীর্ঘজীবন লাভ করা অসম্ভব কিছু নয়।

আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি